ফরয গোসল, গোসলের নিয়্যত, গোসলের ফরযসমূহ, গোসলের সুন্নতসমূহ, গোসলের মুস্তাহাবসমূহ
গোসলের বিবরণ:
মাথা হতে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত উত্তমরূপে পানি দ্বারা ধৌত করাকে ইসলামী শরী'য়তের পরিভাষায় "গোসল” বলে। গোসল সাধারণত চার প্রকার। যথা: ১। ফরয গোসল, ২। ওয়াজিব গোসল। ৩। সুন্নত গোসল। ৪। মুস্তাহাব গোসল।
গোসলের নিয়্যত
নির্জন স্থানে কিংবা গোসলখানায় যেখানে লোকজন না থাকে এমন উপযুক্ত স্থানে গিয়ে প্রথমে গোসলের নিয়ত করবেন
نَوَيْتُ الْغُسْلِ لرفع الجنابة
উচ্চারণ: নাওয়াইতুল গোসলা লিরাফ'য়িল জানাবাতি।
অর্থ: নাপাকীসমূহ দূর করার জন্য আমি গোসল করার মনস্থ করলাম।
গোসলের ফরযসমূহ
ফরয গোসল, গোসল সম্পাদন করার জন্য তিনটি কাজ করা ফরয। যথা: (১) গরগরাসহ তিনবার কুলি করা। (২) নাকের উভয় ছিদ্রে পানি প্রবেশ করিয়ে বামহাতের কনিষ্ঠা ও বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা দ্বারা ভালভাবে নাক সাফ করা। (৩) সমস্ত শরীর পানি দ্বারা খুব ভালভাবে ধৌত করা যাতে একপশম পরিমাণ জায়গাও শুকনা না থাকে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
গোসলের সুন্নতসমূহ
ফরয গোসল, গোসল সম্পাদন করার জন্য চারটি কাজ করা সুন্নত। যেমন-(১) প্রথমে বিসমিল্লাহ্ দোয়া পড়া (২) উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা। (৩) শরীরের যেসব স্থানে নাপাকী আছে সেগুলো উত্তমরূপে ধৌত করা। (৪) গোসলের পর অযু করা। গোসলের স্থান হতে একটু দূরে সরে পা ধৌত করে নেবে। এরপর বামদিকে তিনবার এবং ডানদিকে তিনবার, অতঃপর মাথার উপর তিনবার পানি দিয়ে ধৌত করা।
গোসলের মুস্তাহাবসমূহ
ফরয গোসল, গোসল সমাধা করার জন্য ফরয, সুন্নত কাজ ছাড়াও নিম্নলিখিত কাজসমূহ আদায় করা মুস্তাহাব। (ক) গোসলের নিয়্যত করা, (খ) বিসমিল্লাহ্ পড়ে হাত ধৌত করা, (গ) গোসল করার সময় কা'বামুখী হওয়া (ঘ) সমস্ত শরীর উত্তমরূপে ঘষে-মেজে নেয়া। (ঙ) লজ্জাস্থান ভালোভাবে ঘষে-মেজে নেয়া। (চ) গোসল করার সময় কথা না বলা। (ছ) প্রয়োজনের চেয়ে কম বা বেশি পানি খরচ না করা। গোসল শেষে ভালো পরিষ্কার মোটা কাপড় দ্বারা শরীরের পানি মুছে নেয়া।
গোসলের প্রকারভেদ
গোসল সাধারণত চার প্রকার। যথা- (১) ফরয গোসল, (২) ওয়াজিব গোসল, (৩) সুন্নাত গোসল এবং (৪) মুস্তাহাব গোসল। নিম্নে এগুলোর পৃথক পৃথক আলোচনা করা হল।
ফরয গোসল
নিম্নলিখিত কারণে গোসল ফরয হয়:
(১) কামভাবের উত্তেজনার সাথে কিংবা কোন অবস্থায় বীর্যপাত হলে। (২) মহিলাদের ঋতুস্রাব সমাপ্ত হয়ে রক্ত পড়া বন্ধ হলে। (৩) প্রসবের পর নিফাসের রক্ত পড়া বন্ধ হলে। (৪) সঙ্গম করার সময় লিঙ্গের অগ্রভাগ যোনিপথে প্রবেশ করলে এরূপ অবস্থায় বীর্যপাত না হলেও গোসল করা ফরয হবে।
ওয়াজিব গোসল
নিম্নলিখিত কারণে গোসল করা ওয়াজিব:
(১) মৃত ব্যক্তিকে কাফন-দাফনের জন্য গোসল দেয়া। (২) নাপাকী অবস্থায় কাফির বা মুন্ত্রিক লোক পবিত্র'ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে। (৩) বালেগ হবার পর কোন ছেলে বা মেয়ের স্বপ্নদোষ হলে। (৪) শরীরের অধিকাংশ স্থানে নাপাকী লেগে থাকলে।
সুন্নত গোসল
নিম্নলিখিত কারণে গোসল করা সুন্নত। যথাঃ
(১) শুক্রবার দিন জুমু'আর নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে গোসল করা। (২) দু'ঈদের নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে গোসল করা। (৩) আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্যে গোসল করা, (৪) হজ্জ বা ওমরাহ আদায়ের উদ্দেশ্যে গোসল করে ইহ্রাম বাঁধা। (৫) কাফির ব্যক্তি মুসলমান হয়ে মনের সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে গোসল করা।
মুস্তাহাব গোসল
নিম্নলিখত কারণে গোসল করা মুস্তাহাব। যথাঃ
(১) বেহুঁশ হওয়ার পর হুঁশ এলে গোসল করা। (২) সিঙ্গা দিয়ে রক্ত বের করার পর গোসল করা। (৩) শবে বরাতের নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করা। (৪) 'আরাফার পূর্বরাত্রিতে গোসল করা। (৫) শবে ক্বদরের নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করা। (৬) মক্কা শরীফের নিকটবর্তী মুযদালিফা নামক স্থানে যাওয়ার জন্য গোসল করা। (৭) মীনা বাজারে কুরবানী করার পূর্বে গোসল করা।
(৮) ছাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সা'ঈ বা দৌড়াবার পূর্বে গোসল করা। (৯) মক্কা শরীফে প্রবেশ করার পূর্বে গোসল করা। (১০) চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় গোসল করা। (১১) ইস্তেস্কার নামায আদায়ের জন্য গোসল করা। (১২) ভয়ে অত্যন্ত আতংকিত অবস্থায় পড়ে গোসল করা।
(১৩) ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হলে গোসল করা। (১৪) নবী কারীম (সাঃ)-এর রওজা মুবারক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফে প্রবেশের পূর্বে গোসল করা। (১৫) নতুন কাপড় পরিধান করার পূর্বে গোসল করা। (১৬) মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর গোসলদাতার গোসল করা। (১৭) দূর হতে ভ্রমণের পর বাড়ীতে ফিরে এসে গোসল করা।
ফরয গোসল করার সময় যেসব কাজ করা ঠিক নয়
ফরয গোসল, ফরয গোসল করার সময় নিম্নলিখিত কাজসমূহ করা ঠিক নয়। যথাঃ (ক) পশ্চিম দিকে মুখ করে গোসল করা (খ) খোলামেলা স্থানে গোসল করা। (গ) গোসলের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি পরিমাণে পানি খরচ করা। (ঘ) গোসলের সময় কথাবার্তা বলা।
গোসলবিহীন অবস্থায় যা করা নিষিদ্ধ
যার উপর গোসল করা ফরয হয়েছে সে ব্যক্তির জন্য গোসল না করে নিম্নলিখিত কাজগুলো করা যাবে না। যথাঃ
(১) একান্ত প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে জুযদান কিংবা পাক-পবিত্র কাপড় দিয়ে জড়ানো ছাড়া কোরআন মজিদ স্পর্শ করতে পারবে না। (২) পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে পারবে না। (৩) কোনরূপ নামায পড়তে পারবে না। (৪) মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না।
গোসল সম্পর্কিত কতিপয় প্রয়োজনীয় মাছায়েল
স্বামী স্ত্রীর যোনিপথে লিঙ্গ প্রবেশ করালে উভয়ের প্রতিই গোসল ফরয হবে এতে বীর্যপাত হোক বা না হোক। (হেদায়া)
কোন মহিলা স্বীয় যোনিপথে আঙ্গুল বা এ ধরনের কোনকিছু প্রবেশ করিয়ে কৃত্রিম উত্তেজনার সৃষ্টি করলে বীর্যপাত হোক বা না হোক উক্ত অবস্থায় গোসল করা ফরয হবে।
বীর্যপাতের সময় যদি বীর্য আটকে রাখে এবং উত্তেজনা চলে যাবার পর উক্ত বীর্য বের হয়ে থাকে, তবুও গোসল করা ফরয হবে।
স্বামী-স্ত্রী রাতে একই বিছানায় শুয়েছিল সকালে ঘুম হতে উঠে বিছানা বা কাপড়ে বীর্য দেখা গেল। কিন্তু কারও স্মরণ নেই যে, কিভাবে হল এরূপ অবস্থায় উভয়ের উপরই গোসল ফরয হবে। (বেহেস্তী জেওর)
স্বপ্নের মাধ্যমে সঙ্গম করতে দেখল এবং পূর্ণ তৃপ্তিও পেল, কিন্তু ঘুম হতে উঠে কোনরূপ বীর্যের চিহ্ন দেখা না গেলে গোসল ফরয হবে না।
গোসলের সময় চুলের এবং লোমকূপের গোড়ায় পানি পৌঁছান ফরয। তবে মহিলাদের মাথার চুলে বেনী পাকান থাকলে তা খোলা জরুরি নয়। আর যদি চুলে বেনী পাকান না থাকে তাহলে সম্পূর্ণ চুল ধৌত করতে হবে। (মুনইয়া)
গোসল করার সময় কান ও নাভীর ছিদ্রসমূহে ভালোভাবে পানি পৌছাতে হবে, কারণ এসবগুলো শুকনা থাকলে গোসল শুদ্ধ হবে না। (শঃ তানঃ আছার)
সমস্ত শরীরের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সামান্য চুলের গোড়া পরিমাণ স্থানও যদি শুকনা থাকে তাহলে গোসল হবে না।
দাঁতের ফাঁকে সুপারি বা অন্য কোন বস্তু আটকে থাকার ফলে উক্ত স্থানে পানি না পৌঁছলে গোসল শুদ্ধ হবে না।
নখ বা শরীরের কোন জায়গায় আটা, রং, চুন ইত্যাদি বস্তু লেগে শুকিয়ে গেলে সেগুলো না উঠানো পর্যন্ত গোসল শুদ্ধ হবে না।


0 Comments