ঈদুল আযহার নামায, ঈদুল আযহার নামাযের নিয়ত, ঈদুল আযহার ফজিলত
ঈদুল আযহার নামায।
১০ই জিলহজ্জ্ব ঈদুল আযহার নামায পড়তে হয়। এগার ও বার তারিখেও এ নামায পড়া যায়। সূর্য কিছুদূর উঠার পর থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত এ নামাযের সময় থাকে। এ দিন মেসওয়াক ও অজু গোসল করে ভাল কাপড় পরিধান করে, খুশবু লাগিয়ে তাকবীর বলতে বলতে নামায পড়তে যাবে।
ঈদুল আযহার নামাযের নিয়ত
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّي لِلَّهِ تَعَالَى رَكْعَتَى صَلوةِ الْعِيدِ الأضْحَى مَعَ سِتَّةِ تَكْبِيرَاتِ وَاجِبُ اللَّهِ تَعَالَى اقْتَدَيْتُ بِهَذَ الْإِمَامِ مُتَوَجِهَا إِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ اللَّهُ أَكْبَرُ .
উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন্ উছোয়াল্লিয়া লিল্লা-হি তা'আলা রাক্'আতাই ছলাতি ঈদিল্ আযহা-মা'আ সিত্তাতি তাকবীরাতিওঁ ওয়াজিবিল্লা-হি তা'আ-লা ইকতাদাইতু বি-হাযাল্ ইমা-মি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল্ কা'বাতিশ্ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার।
তাকবীরে তাশরীক
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর হতে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর নিম্নের তাকবীরটি পড়তে হয়। না পড়লে কঠিন গুনাহগার হবে। যদি কখনও কোন ওয়াক্তে পড়তে ভুলে যায়, যখনই মনে হবে তখনই পড়ে ফেলবে।
তাকবীরটি হল:
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ .
উচ্চারণ: আল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার ওয়া লিল্লা-হিল্ হাম্দু।
অর্থ: আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই।। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।
এ তাকবীরই তাকবীরে তাশরীক। এ তাকবীর একবার পড়া ওয়াজেব, তিনবার
পড়া মোস্তাহাব। (মারাক্কিউল ফালাহ্ মিসরী)
ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়
মহান আল্লাহর রহমতে, আমরা ২২শে আগস্ট ঈদ-উল-আযহা উদযাপন করব, ইনশাআল্লাহ। একজন মুমিনের জীবনে ত্যাগের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ একজন মুমিনের জীবনে একমাত্র ইবাদত হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। আর সত্যিকারের ত্যাগ তাকে খুব দ্রুত আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয়। আমরা বাঙালিরা একে ঈদ-উল-আযহা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
কুরবানী শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, ভক্তি। অর্থাৎ, এই ত্যাগ মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। ঈদ-উল-আযহা উদযাপনের মাধ্যমে, বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং হযরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পবিত্র স্মৃতি বহন করে। মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কুরবানী করে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আদেশ করেছেন, ‘অতএব, তোমাদের প্রতিপালকের জন্য নামাজ ও কুরবানী প্রতিষ্ঠা করো।’ (সূরা কাউসার, আয়াত: ২)। কুরবানী একটি প্রতীকী বিষয়। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের জানমাল থেকে শুরু করে আল্লাহর জন্য সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর সমগ্র পরিবারের অভূতপূর্ব ত্যাগের ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একজন মুমিন সর্বদা আল্লাহর জন্য সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.), তাঁর প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরা কর্তৃক আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশকে হজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখিয়েছেন যে তিনি তাঁর পুত্রকে জবাই করছেন। (সূরা সাফ)। কবি নজরুল তাঁর কুরবানী বিষয়ক কবিতায় যেমন বলেছেন: আজ মিনারের মাঠে, পিতামাতার ভালোবাসার ঘাড়ে, ছুরি দিয়ে কাটো না, আব্বা ইব্রাহিম তাকে তার রুদ্রের মুহাম্মদ হিসেবে রেখেছেন! শি চি! কাঁপো না, ছোট্ট মন!
আজ জল্লাদ নয়, বরং প্রহ্লাদের মতো একজন মোল্লা হত্যা করছে! ওহ, এটা খুন নয়, আজ সত্যাগ্রহের শক্তির উদ্বোধন।' বাবা ইব্রাহিম যখন স্বপ্ন পূরণ করতে গেলেন, তখন আল্লাহ বললেন, হে ইব্রাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমার ছেলেকে আমার পথে কোরবানি দিতে, হত্যা করতে নয়। তোমার ছেলে সারা জীবন মানুষকে শিক্ষা দেবে যে আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়।
প্রশ্ন হলো, তাহলে তুমি কেন একটি ভেড়া বা ছাগল জবাই করলে? উত্তর হলো: যদি সেদিন এই ঘটনাটি না ঘটত, তাহলে সেই সময়ের ধর্মীয় রীতি অনুসারে, কিছু জাতির প্রভু বা দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য মানুষ জবাই করা হত। অতএব, আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন যে মানুষ জবাইয়ের বস্তু নয়, তবে যদি জবাই করা প্রয়োজন হয়, তাহলে পশু জবাই করা উচিত।
ইতিহাস আমাদের বলে যে, মহানবী (সা.)-এর সম্মানিত পিতা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাঁর দাদা একশটি উট জবাই করেছিলেন (সীরাত-ই-নববী)। এ থেকে দেখা যায় যে, নবী (সা.) পশু জবাই করার প্রথা চালু করেননি, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হত। পবিত্র কুরআনে পশু জবাইয়ের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ মূসা (আ.)-এর উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, ‘তোমরা যে গরুর পূজা করো, তা উপাসনার যোগ্য নয়, বরং আমি উপাসনার যোগ্য, তাই তা জবাই করো।’ (সূরা আল-বাকারা, রুকু: ৮)।
গরুকে তোমাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যাতে তোমরা এর দুধ পান করতে পারো, এর মাংস খেতে পারো এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য কল্যাণ লাভ করতে পারো। মূল উদ্দেশ্য হলো, যদি হৃদয়ে কোন প্রাণী থাকে, তাহলে সেই প্রাণীকে হত্যা করা উচিত। তাকে জবাই করা উচিত। হাদিসে বলা হয়েছে যে, পশু জবাই করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি উপায়, তবে এটি সেই ব্যক্তির জন্য যে আন্তরিকভাবে, শুধুমাত্র আল্লাহর ভালোবাসার জন্য, ঈমানের সাথে, আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে পশু জবাই করে। এই ধরণের কুরবানীকে আরবীতে ‘নুসাক’ বলা হয়, যার আনুগত্যের আরেকটি অর্থ রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ মানুষের হৃদয় দেখেন, এবং তিনি খুব ভালো করেই জানেন কে কোন উদ্দেশ্যে কুরবানী করছে। প্রকৃতপক্ষে, কুরবানীর শিক্ষা হলো মানুষের মধ্যে সকল লোভ-লালসা দূর করা এবং সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সকল পশুত্ব ত্যাগ করা। অতএব, কুরবানীর ধর্মীয় উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে পশুত্ব হত্যা করে মানবতাকে জাগ্রত করা। কাজী নজরুল ইসলাম তার একটি কবিতায় এই বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন - 'মনের পশু জবাই করো / এমনকি পশুও বেঁচে থাকে, সবাই বেঁচে থাকে।'
এই পশু কুরবানী সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে কুরবানীই ঈদের আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কুরবানী করে মানুষের মধ্যে বিতরণ করার অর্থ দান নয়, বরং কুরবানী। এ কারণেই কবি নজরুল তার 'ঈদজোহা' কবিতায় লিখেছেন, 'তিনি একটি ভেড়া বা উট চাইবেন না, কত দান? আর দান মিথ্যা। আমি কুরবানী চাই, আমি দান চাই না।'
আত্মত্যাগের মহিমায় অনুপ্রাণিত হয়ে নবী (সা.) আল্লাহর নামে কুরবানীকারীদের জন্য অসীম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে পশু কোরবানি সম্পর্কে তাঁর অনুসারীদের উপদেশ দিয়েছেন।
যদি কেউ মনে করে যে সে প্রতি বছর কুরবানি করে, কিন্তু এবার সে তা করেনি, তাহলে এটা সঠিক নয়, কারণ কুরবানি কেবল একবারের জন্য নয়, বরং তার জীবনের বাকি সময়ের জন্য। হাদিস থেকে জানা যায় যে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘হে মানুষ! জেনে রাখো যে, প্রতিটি পরিবার প্রতি বছর কুরবানি করা বাধ্যতামূলক।’ (আবু দাউদ ও আন-নাসাঈ)।
নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষম কিন্তু কুরবানির ব্যবস্থা করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ)। হযরত ইবনে ওমর (রা.) বলেছেন, নবী (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং সর্বদা কুরবানি করেছেন (তিরমিজি)। নবী (সা.) বলেছেন, সর্বোত্তম ইবাদত হলো কুরবানির দিন কুরবানি করা। কুরবানিকারীকে কুরবানির পশুর শরীরের প্রতিটি চুলের জন্য একটি করে সওয়াব দেওয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাইয়ের সময় মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। (মেশকাত)।
কোরবানির সওয়াব পেতে হলে কোরবানি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। কেবল তোমাদের অন্তরের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছায়।’ (সূরা আল-হজ্জ: ৩৭)। অতএব, এই কোরবানি তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে, অথবা আল্লাহর ভয় অর্জনের উদ্দেশ্যে। আর আসল কোরবানি হল নিজের আত্মার কলুষতা, আত্মার অহংকার, আত্মার অহংকার ধ্বংস করা।
এখন আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের এই কোরবানি কি তাকওয়ার কোরবানি, নাকি লোক দেখানো কোরবানি? ঈদুল আযহার ঠিক আগে, রেফ্রিজারেটর কোম্পানির চকচকে বিজ্ঞাপন, ডিপ ফ্রিজারের উপর বিশাল ছাড় - এগুলো কি আমাদের তাকওয়ার দিকে আকৃষ্ট করে নাকি মাংস মজুদ করার দিকে?
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কোন ফ্রিজে কোরবানির মাংস রাখতেন? তিনি নিজে একটু খেতেন এবং বাকিটা সবার মধ্যে বিতরণ করতেন। কেউ কেউ বলতে পারেন যে তখন রেফ্রিজারেটর ছিল না, কিন্তু যদি অতিরিক্ত মাংস থাকত, তাহলে তিনি তা শুকিয়ে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি (সাঃ) কখনও তা করেননি। আমাদের এত বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে, আমরা এর এক তৃতীয়াংশ নিজেরা খাব, এক তৃতীয়াংশ আমাদের আত্মীয়দের এবং এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র ও অভাবীদের।
আসলে, যদি সম্ভব হয়, আমরা সব ফ্রিজে রাখি। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে এক তৃতীয়াংশ দেওয়া হয় এবং বাকি দুটি ফ্রিজে রাখা হয়। যখন আমরা আত্মীয়দের অংশের কথা বলি, তখন তারা বলে, আত্মীয়রা আমাদের বাড়িতে এসে রান্না করা মাংস খাবে! আমরা কত স্বার্থপর। যদি সবাই তাদের অংশ তাদের আত্মীয়দের দান করে, তাহলে সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন হবে এবং আল্লাহ খুশি হবেন। তাহলে আমরা এই বিষয়ে এত কৃপণ কেন?
সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা: হে আল্লাহ, আমাদের এই ত্যাগ কবুল করুন এবং আমাদের আত্মাকে পবিত্র করুন।

0 Comments