হজ্জের বিবরণ | হজ্জের নিয়মাবলী, হজের গুরুত্ব ও ফজিলত

হজ্জের বিবরণ | হজ্জের নিয়মাবলী, হজের গুরুত্ব ও ফজিলত


হজ্জের বিবরণ

যাহাদের (ধন সম্পদের সামর্থ্য) হজ্জে যাইবার ক্ষমতা আছে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ্জ করা তাহাদের উপর ফরয।

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম রোকন। সারা বৎসরের সংসারের সমুদয় খরচ মিটাইয়া যদি মক্কাশরীফ যাওয়ার মত খরচের টাকা জমা থাকে তবে তার উপর হজ্জ করা ফরয। জীবনে একবারই হজ্জ ফরয হয়। কিন্তু ইচ্ছা করলে অনেক বার নফল হজ্জ করতে পারে যদি সামর্থ্য থাকে।

জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে কতকগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করাকে হজ্জ বলে। যখন যাহার উপর হজ্জ ফরয হয় তখনই হজ্জ করা কর্তব্য। নতুবা পরে আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য হজ্জ করতে না পারলে গোনাহগার হইবে।

নবী করীম (সঃ) বলেছেন, হজ্জের উপযুক্ত হইয়া যদি কেহ হজ্জ না করিয়া মারা যায় সে যেন ইহুদী নাছারার ন্যায় মৃত্যুমুখে পতিত হইল।

যাহার উপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তাহার পক্ষে হজ্জ হইতে ফিরিয়া আসার সময় পর্যন্ত পরিবারের ভরণ পোষণ ও মক্কা শরীফ পর্যন্ত যাতায়াতের খরচ থাকিলেই তাহাকে হজ্জ করতে হইবে। পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাহাদের অনুমতি ব্যতীত হজ্জে যাওয়া জায়েয নাই।

স্ত্রীলোকের উপর হজ্জ ফরয হইলে স্বামী অথবা মারুম ব্যক্তি যাহাদের সাথে বিবাহ জায়েয নাই সে সমস্ত পুরুষের সংগে হজ্জে যাইতে হইবে। শরীয়তে নিষিদ্ধ এরূপ ধার্মিক সুফি মুত্তাকী ব্যক্তির সহিতও হজ্জে যাওয়া জায়েয নাই। এমনকি একাকী যাওয়াও স্ত্রীলোকের পক্ষে জায়েয নাই।

হজ্জের শেষে অথবা হজ্জের পূর্বে মদীনা শরীফে যাইয়া নবী পাকের (সঃ) রওযা মুবারক জিয়ারত করা অবশ্য কর্তব্য। নবী করীম (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার রওযা জিয়ারত করিবে তাহাকে সাফায়েত করা আমার জন্য ওয়াযিব। তিনি আরও বলেছেন, হজ্জ করিয়া যে আমার রওযা জিয়ারত করিল সে যেন আমাকে জীবিত দর্শন করিল।

হজ্জের প্রকারভেদ

হজ্জ তিন প্রকার। যথাঃ (১) ক্বিরান (২) তামাতু (৩) ইফরাদ।

(১) কিরান: ওমরা ও হজ্জের নিয়ত একত্রে করে ইহরাম বেঁধে প্রথমতঃ ওমরা সমাধা করে ইহরাম না খুলে হজ্জের জন্য অপেক্ষা করা এবং হজ্জের সময় হলে হজ্জের কাজ সমাধা করাকে হজ্জে কেরান বলে। হানাফী মাজহাব মতে হজ্জে ক্বেরান সবচেয়ে উত্তম।

(২) তামান্তু: হজ্জের মৌসুমে শুধু ওমরার জন্য ইহরাম বেঁধে ওমরা আদায় করতঃ ইহরাম খুলে হালাল হয়ে পুনরায় হজ্জের সময় এলে হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ্জের কার্যাবলী সমাধা করাকে তামান্তু হজ্জ বলে।

(৩) ইফরাদ: হজ্জের সময় শুধু হজ্জের ইহরাম বেঁধে হজ্জ করাকে হজ্জে ইফরাদ বলে।

হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তসমূহ

১। মূসলমান ২। প্রাপ্ত বয়স্ক ৩। স্বাধীন ৪। সজ্ঞান ৫। দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ৬। হজ্জের মৌসুমে হজ্জ করিবার মত সঙ্গতি থাকা অর্থাৎ যাতায়াত ও খাওয়া খরচ চলে এবং ফিরিয়া আসা পর্যন্ত পরিবারের লোকজনের আহারাদির ব্যবস্থা হয়।

উপরোল্লিখিত শর্ত পাওয়া গেলে জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। যেই বৎসর হজ্জ ফরয হয় সেই বৎসর হজ্জ করা উচিত। পরে গরিব হইয়া গেলে গুনাহগার হইয়া থাকিবে। সুদ, ঘুষের টাকা দিয়া হজ্জে যাওয়া না জায়েয। 

ভিক্ষা করিয়া হজ্জে যাওয়া অনুচিত। স্ত্রীলোক হজ্জে গমন করিলে স্বামী, পিতা, ছেলে ইত্যাদি মাহরুম ব্যক্তি সঙ্গে যাইতে পারে, অন্যথায় হজ্জ আদায় করা ফরয নহে।

হজ্জের ফরজ কাজসমূহ

(১) এহরাম বাঁধা (২) আরফাতে অবস্থান করা ও (৩) কাবা ঘর তওয়াফ করা।

হজ্জের ওয়াযিব কাজসমূহ

(১) মুজদালেফায় রাতে অবস্থান করা। (২) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ান। (৩) মীনায় কঙ্কর মারা। (৪) কিরান বা তামাকু হজ্জ সম্পাদনকারীর দম দেয়া। (৫) কেশ মুণ্ডন করা। (৬) বিদায়ী তাওয়াফ করা।

হজ্জের সুন্নত কাজসমূহ

(১) মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী মুফরিদ (অর্থাৎ যে শুধু হজ্জ করে) এবং কারিন (যে ওমরা ও হজ্জ একই ইহরামে আদায় করে) এর তাওয়াফে কুদূম করা। (২) তওয়াফে কুদূম এ রমল ও ইজতেবা করা।

(৩) যিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা। (৪) যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে সূর্য উদিত হওয়ার পর মিনা হতে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। (৫) আরাফা থেকে সূর্য অস্ত যাবার পর হজ্জের ইমামের রওয়ানা দেয়ার পূর্বে রওয়ানা হওয়া। (৬) আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করে মুযদালিফায়
রাত যাপন করা। (৭) আরাফাতের ময়দানে গোসল করা। (৮) মীনায় অবস্থানকালীন (১০, ১১ ও ১২ যিলহজ্জের) রাতগুলো মীনায় যাপন করা।

হজ্জের সময় নিষিদ্ধ কাজসমূহ

পুরুষদের সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করা, মাথা/মুখমণ্ডল ঢাকা, এমনকি জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থায়ও, সুগন্ধী জাতীয় যে কোন কিছু ব্যবহার করা, চুল, দাঁড়ি, গোফ, নখ কাটা;

পশু-পাখি শিকার করা, মশা-মাছি মারা, উকুন মারা, পোকা-মাকড় মারা, যে কোন গাছের ডাল ভাংগা বা পাতা ছেঁড়া, জুতা পরিধান করা, স্বামী স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্ক এমনকি ঐ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করা, ঝগড়া-বিবাদ ও অশ্লীল কথাবার্তা, গীবত, অপবাদ, হাসি, তামাশা করা, জর্দা/সুগন্ধি দিয়ে পান চিবানো। পুরুষের ইহরাম অবস্থায় মাথা ঢাকা যাবে না এমনকি নামায পড়ার সময়ও।

হজ্জে সম্পাদন করার নিয়মাবলী

১। মাতা-পিতা আত্মীয়স্বজনদের নিকট অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও বিদায় নেয়া।

২। নিজের বিগত জীবনের সমস্ত পাপের কথা স্মরণ করিয়া আল্লাহ পাকের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করা।

৩। শত্রু-মিত্র সবার নিকট নিজের অন্যায় কাজের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও বিদায় নেয়া।

৪। কাহারো নিকট কোন দেনা থাকিলে তাহা পরিশোধ করা। স্ত্রীর মোহরানার টাকা পরিশোধ অথবা ক্ষমা চাহিয়া নেয়া। পাওনাদারের মৃত্যু হইয়া থাকিলে তাহার ওয়ারিশদেরকে পাওনা টাকা পরিশোধ করা। যদি কোন ওয়ারিশ না থাকে তবে তাহার নামে প্রাপ্য টাকা হিসাব করিয়া দান করিয়া দেয়া।

৫। কাহারও কোনকিছু আমানত থাকিলে তাহা মালিককে ফিরাইয়া দেয়া।

৬। ক্রোধ, লোভ, হিংসা, অহংকার মন হইতে দূর করিয়া শান্ত ও পরহেজগারী ভাব অবলম্বন করা।

৭। কাহারও উপর কোন অন্যায় অত্যাচার করিয়া থাকিলে তাহার নিকট হইতে ক্ষমা চাহিয়া লওয়া। সে যদি মরিয়া যায় তবে উক্ত অপরাধের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট তওবা করা এবং ক্ষমা চাওয়া।

৮। সুদ, ঘুষ, চুরি বা অন্য কোন প্রকার অন্যায়ভাবে উপার্জিত অর্থ হজ্জে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিবে না।

৯। হজ্জে গমনের পূর্বে এ বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞ লোকের সহিত আলোচনা করিয়া তাহার উপদেশ লওয়া এবং সৎ সঙ্গীসহ গমন করা।

১০। হালালভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা হজ্জে গমন করা উচিত। নচেৎ হজ্জ হবে না।

ওমরা আদায়ের নিয়মাবলী

হজ্জ ও ওমরার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- প্রতি বছর নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে হেরেম শরীফ, মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাহসহ অন্যান্য স্থানে গিয়ে নির্দিষ্ট হুকুমসমূহ পালন করার নাম হজ্জ।

হজ্জের সময় ব্যতীত বছরের অন্যান্য সময় ইহরাম বেঁধে ওমরার নিয়তে বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ ও সাঈ করে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেটে হালাল হওয়ার নাম ওমরাহ।

اللهم اني اريد العمرة فيسرها لي وتقبلها منى *

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী উরীদুল উ'মরাতা ফাইয়াসিরহা- লী ওয়া * তাক্বাব্বালহা- মিন্নী।

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি উমরাহ পালন করার জন্য ইচ্ছা করছি; আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।

মদীনা শরীফের যিয়ারত

পরিত্র হজ্জে গমন করে হজ্জের পূর্বে বা পরে মদীনা শরীফে পৌঁছে রাসূলে করীম (সঃ) এর রওজা এবং মসজিদে নববী যিয়ারত করা উচিত এবং সেখানে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায আদায় করা উত্তম। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর উপর।

হজ্জের বিস্তারিত বর্ণনা এ পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। তাই হজ্জ সংক্রান্ত বই-পত্রাদি হতে হজ্জের যাবতীয় মাসআলা ও দোয়া সমূহ হজ্জ গমনেচ্ছুদের প্রতি জেনে নেয়ার অনুরোধ রইল।

স্বপ্নের মাধ্যমে রাব্বুল 'আলামীনের নির্দেশানুসারে ইব্রাহীম (আঃ) স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে তিনি হযরত ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানী করেছিলেন।

উক্ত সময় হতে পশু কোরবানী করার নিয়ম চলে আসছে। কোরবানী সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- "কোরবানীর দিনে আল্লাহর নিকট কোনবানীর চেয়ে প্রিয় আর কিছু নয়।"

প্রত্যেক ধনী মুসলমানের পক্ষে কোরবানী করা ওয়াজিব। নিজের নামে ওয়াজিব কোরবানী দিয়ে বাপ-মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নামে বা মৃত মা-বাবার নামে কোরবানী দেয়া দুরস্ত আছে। ঈদুল আযহার দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে বেলা বারটার পূর্বে ঈদুল আযহার নামায আদায়ের পর কোরবানী করতে হয়।

Post a Comment

0 Comments