হযরত শাহ্ জালাল (রহ.), হযরত শাহজালাল রাঃ এর জীবনী, হযরত শাহজালালের অলৌকিক ঘটনা
জন্ম ও পরিচয়ঃ বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সৃফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যকরা যায় তিনি সুলতানুল বাংলা, হযরত আল্লামা শাহ্জালাল মুজাররাদে ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি। শাহজালাল মুজাররাদে ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর পূর্ণ নাম জালালুদ্দীন।
আপামর জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত নাম হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি। ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণের তথ্যগত বিচ্যুতি ও মতভেদের কারনে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের জীবন ইতিহাস নিয়ে দ্বন্ধ সৃষ্টি হলেও উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, হযরত শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনিই ইবনে বতুতা বর্ণিত জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি যা সমসাময়িক এবং পরবর্তী নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বহুমুখি গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারনে বাংলার মুসলিম সমাজে বহু লকব বা গুণবাচক উপাধি দ্বারা বিভূষিত। বিভিন্ন শিলালিপি, ঐতিহাসিক মনীষীগণের বর্ণনা ও গবেষকগণের রচনাবলীতে সাধারণত নিম্নলিখিত লকবগুলি পাওয়া যায়ঃ শেখ, শায়খুল মাশায়েখ, কুতুব, মুজাররাদ, মখদুম, সুলতানুল বাংলা, আরিফান বুয়দ, কুতুব বুয়দ, মাওলানা, জালালুদ্দীন, তাবরিজী, ইয়েমেনী, কুন্যাভী, তাইজী, সিরাজী, প্রাচ্য-সূর্য, ইত্যাদি। উনার কুনিয়াত হল কোরাইশী।
ঐতিহাসিক ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে গবেষকগণের মতে হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ৫৯৬ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। উনার জন্মস্থান হল ইয়েমেনের তাইজ নগরীর কুন্যা নামক স্থানে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কোন কোন লেখক হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে আলাদা দু জন দরবেশ বর্ণনা করেন এবং জালালুদ্দীন তাবরিজীর জন্ম ও ইন্তেকালের তারিখ এবং পান্ডুয়াতে উনার মাযার শরীফ বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু যে সমস্ত গ্রন্থের সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে তার মূল গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়নি এবং পান্ডুয়াতে উনার মাযার শরীফ নেই বলে সেখানকার খাদেমগণই বর্ণনা করেন। সেখানে উনার জওয়াব সমাধি বা স্মৃতি সৌধ বিদ্যমান।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, Hazrat Shahjalal International Airport, হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) এর নামে নাম করণ করা হয়েছে।
শিক্ষাঃ হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পিতা-মাতা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন উনার বুযুর্গ মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি সোহ্রাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ এবং মক্কার বিশিষ্ট আলেম ছিলেম।
হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে তাঁর মুরীদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আলেম ছিলেন।
(মুলত: ইলমে তাসাউফের উচ্চ মাকাম হাসিল কারি গন ইলেম লাদুনি প্রাপ্ত হন অর্থ্যাৎ আল্লাহ্ পাক উনার প্রদত্ত ইলিম হাসিল করেন।
ইতিহাসে আমরা এরকম আরো নজির দেখতে পাই যেমন ইমান আবুল হাসান খারকানি রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কোন দুনিয়াবী শিক্ষকগণের কাছ থেকে ইলিম বা তালিম গ্রহন না করেও তিনি ইলিমে শরিয়ত ও ইলমে তাসাউফ উনার গভীর ইলিম রাখতেন)
এছাড়াও হযরত শায়খ আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মতে জগত খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুযুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্যও হযরত কুতুব উদ্দীন বস্তিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি,
হাদীস বিশারদ হযরত বাহাউদ্দীন যাকরিয়া মুলতানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বোরহানুদ্দীন সাগরজী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মত যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সাথে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞান রাজ্যের বিভিন্ন শাখায় ও বুৎপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি শৈশব থেকে প্রায় ২২/২৩/৩০ বছর পর্যন্ত মামা হযরত সৈয়দ আহমদ কবির সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর নিবিড় তত্ত্বাবধানে শরীয়ত ও তাসাউফে (মারফতের) গভীর জ্ঞান লাভকরেন। এরপর তিনি আবু সাঈদ তাবরিজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বায়াত গ্রহন করেন এবং উনার সোহবতে প্রায় দুই বছর কাটান।
এরপর হযরত শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি সোহ্রাওয়ার্দী ত্বরিকার ইমাম হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট মুরীদ হন। এ সূত্রে হযরত শেখ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি হন উনার পীর ভাই বাসতীর্থ। শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রায় ৭ বৎসর শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সোহবতে কাটান।
উনার বিশাল শরীফের পর হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সুযোগ্য পুত্র শায়খ হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট মুরীদ হন এবং দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর তাঁর খেদমতে কাটান।
বুজুর্গগণের সাক্ষাতঃ ফারসী মালফুযাত ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ অনুসারে হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মুরীদ থাকাকালে বাগদাদে তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে সাক্ষাত করেন। তারিখে ফিরিশতার বর্ণনা অনুসারে তিনি নিশাপুরে হযরত শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথেও সাক্ষাত করেন।
সফরঃ হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কর্মময় জীবনে বহু দেশ সফর করেন তিনি ইয়েমেন মিশর, তুরস্ক, তৎকালীন জাজিরাতুল আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের ব্যাপক অঞ্চল সফর করেন। সে সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রগুলোর প্রায় সব জায়গা যেমন মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, নিশাপুর, গারজু, সমরকন্দ, বোখারা, মুলতান, বদায়ুন, দিল্লী, আজমীর ইত্যাদি অঞ্চলগুলো সফর করেন।
পাক-ভারত উপমহাদেশে শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি একাধিকবার ভ্রমণ করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজের ও তবকাতে নাসিরীর বর্ণনানুসারে হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি মুলতানের সুলতান নাসিরুদ্দীন কুবাচা এবং দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশের শাসনামলে বঙ্গ অঞ্চল সফর করেন।
তখন তিনি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ ছিলেন। ধর্মপরায়ণ সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ হযরত কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর মুরীদ ছিলেন।
স্বপ্ন পুরণের পথেঃ বিভিন্নজীবনী লেখকগণের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশের সিলেটের আগমনের পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুর্শিদ ও মামা সৈয়দ আহমদ কবীর সোহ্রাওয়ার্দী এবং সঙ্গীয় পীর বাহাউদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দীর নিকট বর্ণনা করেন।
স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে অবিলম্বে হিন্দুস্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে মুর্শিদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাইবে সেখানেই তুমি অবস্থান ঠিক করিবে।
তিনি আরও বললেন, এই মৃত্তিকা মুষ্ঠি যে স্থানে পরিত্যাগ করিবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকিবে না। পীরের নির্দেশের পর হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশে আসার আগে জন্মভূমি ইয়েমেন গমন করেন।
সেখানে পূর্বপুরুষ ও মাতা-পিতার মাযার যিয়ারত করেন এবং উলুহিয়াতের তত্ত্ব প্রচার করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁর দিকে ধাবিত হয়।
এতে ইয়েমেনরাজ ঈর্ষান্বিত হয়ে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কে বিষ মিশ্রিত শরবত দ্বারা কামালত পরীক্ষা করতে চাইলেন। হযরত শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বিষ মিশ্রিত শরবত বিস্মিল্লাহ বলে পান করলে সে. বিষের প্রতিক্রিয়ায় উল্টো ইয়েমেন রাজ-ই মৃত্যুবরণ করে।
ইয়েমেনের পরবর্তী রাজা শাহ্জাদা আলী পিতার মৃত্যু এবং শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কারামত দেখে উনার ভক্তে পরিণত হন এবং শাসকের তখণ্ডতে (সিংহাসনে) না বসে শায়খ শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথী হতে চাইলেন কিন্তু হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে ইয়েমেন হতে যাত্রা করেন।
ইয়েমেন হতে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদ আসেন। বাগদাদে হযরত বাহাউদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট হতে পুনরায় বিদায় গ্রহন করেন। সেখানে থেকে বিশ্বের প্রধান প্রধান জনপদে কিছু দিন করে অবস্থান করে সমরকন্দ, আফগানিস্তান হয়ে মুলতান উপস্থিত হন।
মুলতান হতে হযরত শাহ্জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে এসে উপস্থিত হন। ইয়েমেনের শাহ্জাদা আলী সিংহাসন ছেড়ে এ সময়ে উনার সাথে মিলিত হন। দিল্লীতে হযরত নিজামুদ্দীন আউলীয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়।
কারামতঃ হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে অবস্থান কালে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এর একজন মুরিদ জানালেন যে, আরব দেশ থেকে এক দরবেশ এসেছেন তিনি নারী মুখ দর্শণ করেন না। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে পথ চলেন এবং সব সময একজন কম বয়সী সুদর্শন রালক কে সঙ্গে রাখেন।
হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উৎসুক হয়ে একজন মুরিদকে পাঠালেন দরবেশকে নিয়ে আসার জন্য। হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি অবস্থা বুঝতে পেরে প্রেরিত মুরিদের হাতে একটি কৌটার মধ্যে তুলা দিয়ে তার উপরে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার (কয়লা) দিয়ে কৌটার মুখ বন্ধ করে ফেরত পাঠান।
হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি কৌটার মুখ খুলে দেখলেন যে, তুলার উপর একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কিন্তু এতে তুলার একটি আশও জ্বলছে না।
হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি এ ঘটনা থেকে আগত দরবেশের কামালিয়াত ও ফজিলত বুঝতে পারলেন এবং নিজেই হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি সাথে সাক্ষাত করেন এবং শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ একজোড়া কবুতর উপহার দেন।
সে সময় থেকে আজও এ কবুতর জালালী কবুতর নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। দিল্লী থেকে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মুর্শিদ প্রদত্ত মাটি সহকারে বাংলাদেশে আগমণ করেন। খুলনা, রংপুর, সোনারগাঁ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন।
এখানে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হল, হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান কুমিল্লা সফর করছিলেন তখন কুমিল্লার মাটির সাথে মুর্শীদ প্রদত্ত মাটির মিল পেয়ে তিনি বলেছিলেন কুহু মিলা। কিংবদন্তি অনুসারে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেখান থেকে কুমিল্লা শব্দটির উৎপত্তি।
কুমিল্লার যে স্থানটিতে একটি টিলার উপরে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছু দিন অবস্থান করে মোরাকাবা জিকির আসকার ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন ছিলেন, সেখানে উনার কর্তনকৃত চুল ও নখ প্রোথিত আছে। এখানে নয়নাভিরাম টিলার উপরে ঐ আস্তানাটি রয়েছে।
আস্তানাকে কেন্দ্র করে একটি জওয়াব সমাধী, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। বর্ণিত রয়েছে যে, এই আস্তানাটির নিকটবর্তী শাহপুর গ্রামে ভারতের ভাগলপুর হতে আগত প্রায় ২৫০ বছর পূর্বের প্রসিদ্ধ আউলিয়া হযরত শাহ্ নুরুদ্দীন আলক্বাদেরী প্রকাশ্যে হযরত বন্দী শাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মাজার শরীফ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম হযরত শাহ্ আমানত রহমতুল্লাহি আলাইহি খানকায় পদব্রজে সফর করতেন।
সিলেট বিজয়ঃ সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে ৭০৩ হিজরীতে শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে গৌড় গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শিশু পুত্র হত্যার প্রতিবাদনার্থে প্রেরিত সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌড় গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার কারণে বারবার পরাভূত হয়।
অবশেষে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াই কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম সহযোগে গৌড় গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাকে পরাভূত করে সিলেট বিজয় করেন।
রিয়াযত ও সাধনাঃ হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ইবাদত ও রিয়াযত- সাধনার এক বিস্ময়কর প্রতিক। তিনি সায়েমুদ্দহর ও কায়েমুললাইল ছিলেন অর্থাৎ নিষিদ্ধ দিন ব্যতীত সারা বছর দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে ইবাদতের হক আদায় করতেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি কোন রাত্র কিয়ামের জন্য, কোন রাত রুকু, কোন রাত সিজদার জন্য নির্দিষ্ট করে নিতেন। নিম্নে উনার ইবাদত ও রিয়াযত-সাধনার কয়েকটি ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হল।
ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন, তিনি (শায়খ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি) ৪০ বৎসর হতে বরাবর রোযা রাখতেছিলেন। দশ দিন অন্তর তিনি ইফতার করতেন। উনার শরীর মুবারক ছিল পাতলা, আকৃতিতে ছিলেন লম্বা গন্ডদ্বয় ছিল ক্ষীণ। ইবনে বতুতা আরো বলেন, সে দেশের হিন্দু মুসলমান সকলে শায়খের দর্শনের জন্য আসত এবং উনাকে হাদিয়া (নযরানা) প্রদান করত। তা ফকির ও কাঙাল সকলেই খেত কিন্তু শায়খ কেবল একটি গরুর দুধ পান করতেন।
হযরতের বুযুর্গীঃ হযরত শায়খ শাহ্ জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনা বুযুর্গী ও কামালত সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালাই উত্তম অবগত। আমরা কয়েকটি ঘটনা ও মনীষীর উক্তি তুলে ধরছি।
হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন উনার মামা সৈয়দ আহমদ কবির রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তত্তাবধানে ছিলেন তখন মামার মনোভাব অনুসারে একটি বাঘের যথাযথ উপযুক্ত বিচার সম্পন্ন করার পর সৈয়দ আহমদ কবির রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন জালাল সুমা বকামাল রছিদি। অর্থাৎ জালাল তুমি আত্ম উন্নতির চরম শিখরে পৌছিয়াছ।
ফাওয়ায়েদুলফওয়াদ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, একবার শায়খ শিহবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী মক্কা শরীফ হতে আসার পথে ভক্তগন তাঁকে অনেক নজর- নেয়াজ প্রদান করলেন। এক গরিব বৃদ্ধাও হযরতকে একটি দিরহাম প্রদান করলেন। তিনি তাঁর সাথী দরবেশগণ কে প্রাপ্ত দ্রব্য সামগ্রী থেকে নিতে আদেশ দিলেন এবং সকলেই নিজের ইচ্ছামত সামগ্রী উঠিয়ে নিলেন।
হযরত শাহজালাল রাঃ এর জীবনী
হযরত শায়খ জালাল কিছুই নিলেন না। শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছু নিতে বললে শায়খ জালাল গরিব বৃদ্ধার দেওয়া দিরহামটি উঠিয়ে নিলেন। তা দেখে শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, জালালুদ্দীন!
বাহ্যত যদিও তুমি একটি দিরহাম গ্রহণ করলে যাহা সকলের চোখেই নগন্য কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তুমি এমন জিনিস গ্রহণ করলে যা ওই সকল মূল্যবান দ্রব্যাদির আত্মা স্বরূপ তুমি অন্যান্যদের জন্য কিছুই রাখিলেনা চতুর্দশ শতকের বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি কে কেন্দ্র করে লিখেন, অলিয়্য মিনাল আউলিয়া বা আউলিয়াদের ওলি, মিনাল কুবারুল আউলিয়া বা শ্রেষ্ঠ আউলিয়াগনের অন্যতম, মাসিরাল আযিমা বা মহান নির্দেশনাবলির স্থাপয়িতা ও আফরাদুর রিজাল বা মানুষের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বলে উল্লেখ করেছেন।
ইবনে বতুতার বর্ণনায় আরো জানা যায় যে, চীনের বিখ্যাত সূফী সাধক শায়খ বুরহানউদ্দীন সাগরজী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রসঙ্গক্রমে বলেন, আমার ভাই শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি এর পদবী ইহা অপেক্ষা অনেক উর্ধ্বে। সংসারের সমস্ত ব্যাপারে তাঁর অধিকার আছে। তিনি আরো বলেন, আমি জানি তিনি প্রত্যেক দিন ফজরের নামায মক্কা শরীফে পড়তেন এবং প্রত্যেক বছর হজ্ব পালন করতেন।
তিনি আরাফা এবং ঈদের দিনে অদৃশ্য হয়ে যেতেন কারো কোন খবর হতো না। এছাড়াও ওই সময়ের বিভিন্ন শিলালিপিতে খোদিত আছে, জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ আরিফান বুয়দ। অর্থাৎ জালালুদ্দীন আল্লাহর দ্বীপ্তি এবং আরেফগণের গৌরব। জালালুদ্দীন কুতুব বুয়দ অর্থাৎ জালালুদ্দীন কুতুবগনের সুঘ্রাণ। সাকিন আউজ জান্নাত ওয়ালা অর্থাৎ বেহেস্তে তাঁর স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমাজ জীবনে হযরতের প্রভাবঃ হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রেমময় দ্বীনের যে প্রদীপ শিখা আল্লাহ্র হুকুমে এ বংগ অঞ্চলে জ্বালিয়েছেন তাঁর আলোয় কত যে অসংখ্য অন্ধকার হৃদয় আলোকিত হয়েছে তা আল্লাহ্ তায়ালাই ভাল জানেন। বস্তুত তিনি নিজেই আলোক শিখা।
উনার আলোয় আলোকিত পুরো বঙ্গ অঞ্চল। এ দেশের জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে, লোক সাহিত্যে, ধ্রুবপদী সাহিত্যে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সব ক্ষেত্রেই হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার প্রভাব পাওয়া যায়।
চিশতিয়া ত্বরিকার বুযুর্গগনের মালফুযাত, বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্তি বাংলার শাসকদের বিভিন্ন স্থাপনা ও শিলালিপি, উনার নামে স্থানের নামকরণ ও মুদ্রা প্রচলনই তা প্রমান করে। বাংলার ইতিহাসে এমন কোন শাসকের দরবার নেই যে হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরবারের অনুগ্রহে অনুসৃহীত হতে চায়নি।
এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কালেক্টর লিন্ডসের আত্মজীবনী থেকে সামান্য উল্লেখ করা হলো সিলেট পৌছার পর আমলারা আমাকে জানালেন যে, সিলেটের শাসনকর্তার প্রথম কর্তব্য হযরত শাহজালালের দরবারে যেয়ে উনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। ভারতবর্ষের দুর-দুরান্ত হতে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা এই দরবার জিয়ারত করতে আসেন।
আমি প্রচলিত প্রথা মোতাবেক জুতা বাহিরে রেখে দরবারে যেয়ে পাঁচটি মোহর নজরানা দিলাম। এরূপে অভিসিক্ত হয়ে আমি প্রজাদের আনুগত্য গ্রহণ করলাম। বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেখা গেছে যারা সিলেট-১ সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয় তারাই সরকার গঠন করে এবং বর্তমান পর্যন্ত এটা বাস্তব বলে প্রমানিত হয়েছে।
এদেশের রাজনৈতিক শাসক যারাই হোকনা কেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগণের হৃদয়ের মনিকোঠায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে সমাসীন হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এতদঞ্চলের মুকুটহীন সম্রাট। আর এ কারণেই সিলেটকে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও পূণ্যভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইন্তেকালঃ ৭৪৬ হিজরি সনের ১৯শে জিলক্বদ হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি ১৫০ বছরে ইন্তেকাল করেন।
তথ্যসুত্রঃ
শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি, মুফতি আজহারুদ্দীন সিদ্দিকি, উৎস প্রকাশন ঢাকা, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২০০২।
শ্রীহট্টের ইতি বৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, দরবেশ শাহজালাল অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি: প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম: উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
শাহ জালাল (র:), আব্দুল করিম; বাংলাপিডিয়া (সিডি সংস্করণ), ভাষণ ২.০.০। প্রকাশকাল: ২০০৬।
জীবনি গ্রন্থ: শাহজালাল (রহ), শাহ ওয়ালী উল্লাহ, প্রকাশনায়- ছাফা বুক করপোরেশন ঢাকা, প্রাকাশ কাল জুলাই ১৯৯৭।
সিলেট বিভাগের ভৌগোলিক ঐতিহাসিক রুপরেখা, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রকাশক- শেখ ফারুক আহমদ, পলাশ সেবা ট্রাস্ট সিলেট, প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ২০০১১, পৃঃ ১০,
হযরত বুরহান উদ্দীন জীবনী গন্থগোলজারে আলম ক্বারী মোহাম্মদ নুর উদ্দীন চিশ্ত্তী, প্রকশনায়-মোহাম্মদ্দ আতাউর রহমান, প্রকাশ কাল নভেম্বর ২০০০
জিয়াউল হক, মো., হযরত শাহ্ জালাল (রা.): একটি মহাকাব্য, ঢ়. ৮৯, চৈতন্য প্রকাশনী, সিলেট, ২০১৫

0 Comments