হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রহ.) এর পরিচয়, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না এর জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রহ.) মাজার কোথায় অবস্থিত

হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রহ.), শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না রাঃ এর জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্নার জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্নার অলৌকিক ঘটনা, শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না মাজার ছবি, শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না রহ জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্নার ছবি, শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না নামের অর্থ কি, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না রাঃ এর জীবনী pdf, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রাঃ), হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না এর পরিচয়, Hazrat Shah Mohammad Ibrahim Ali Tashna (R.), হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রা), হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্নার বাড়ি কোথায়, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রঃ) জীবনী, শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না কে ছিলেন?, শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্নার মাজার কোথায় অবস্থিত?, একনজরে শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না এর জীবনী,

হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রহ.) এর পরিচয়, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না এর জীবনী, হযরত শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী তশ্না (রহ.) মাজার কোথায় অবস্থিত

জন্ম ও পরিচয়ঃ জন্ম ও পারিবারিক জীবনে নাম শাহ মোহাম্মদ ইবরাহীম আলী, 'তশ্না' উপাধিতে ব্যাপক পরিচিত, তাঁর বংশ-পরিচয় 'ফারুকী' নামে। ১২৮৯ হিজরি মোতাবেক ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বাটই আইল গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম।

পিতা কাদরিয়া তরিকার প্রখ্যাত পীর মাওলানা শাহ্ আবদুর রহমান কাদরী এবং বড় ভাই 'বাংলার তোতা'-খ্যাত মাওলানা ইসমাঈল আলম ছিলেন বাংলাভাষী উর্দু কবিদের মধ্যে অন্যতম। ইবরাহীম তশ্নার পূর্বপুরুষ শাহ তকিউদ্দীন (রাহঃ) ছিলেন সিলেট-বিজয়ী কিংবদন্তি হযরত শাহজালাল (রাহঃ)-এর অন্যতম সফর-সঙ্গী এবং পবিত্র মক্কানগরী হতে আগত কোরাইশ বংশোদ্ভূত, তকিউদ্দীনের মাজার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের শেখপাড়ায় অবস্থিত।

শিক্ষাজীবনঃ প্রাথমিক শিক্ষা পিতার একান্ত তত্ত্বাবধানে, তারপর তদানীন্তন আসাম প্রদেশের খ্যাতনামা ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ইবরাহীম তশ্না। সেখানে আলেম এবং সুফিপণ্ডিত মাওলানা আব্দুল ওহাব চৌধুরীর সাহচর্যে ইসলামি শিক্ষার পাঠ শুরু করেন। প্রখর মেধাবী তশ্না এখানে আরবি, ফারসি শিক্ষা লাভে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে বেশ সুনাম অর্জন করেন।

ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে চলে যান ভারতীয় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বিশ্বখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দ-এ। সেখানে তিনি হাদিস-শাস্ত্রে ১ম স্থান অধিকার করেন। দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্তির পরও তশ্না-র জ্ঞানপিপাসা মেটেনি, তিনি চলে যান দিল্লি। দেওবন্দ ও দিল্লির একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটানা নয় বছর অধ্যয়ন করে ইলমে-হাদিস, উর্দু এবং ফারসি ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

শিক্ষা আন্দোলনঃ নয় বছর জ্ঞান-সাধনার পর ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তন্না দেশে ফিরেন। মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা তাঁর মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নয় বছরের অর্জিত জ্ঞান তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হন। এ উদ্দেশ্যে একদিন পার্শ্ববর্তী সাত গ্রামের জনসাধারণকে নিয়ে স্থানীয় উমরগঞ্জ বাজারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন।

সভায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর বক্তব্য দিয়ে শেষ পর্যায়ে হঠাৎ বলেন, 'আমি দীর্ঘ নয় বছর বিদেশে থেকে আপনাদের জন্য সামান্য খেজুর নিয়ে এসেছি। আমার ইচ্ছা আজকের সভায় খেজুরগুলো বণ্টন করে দিই।' জনতার অনেকেই খেজুরের আশায় এদিক ওদিক তাকালো!

তিনি তখন বললেন, 'এ খেজুর ইলমে দ্বীনের খেজুর। আজ আমি এ মাটিতে ইলমে দ্বীনের একটি বীজ রোপণ করতে চাই, ইলমে দ্বীনের এ বীজের বদৌলতে ইসলামের আলো চিরদিন জ্বলতে থাকবে।' এ কথা বলে উপস্থিত জনতার মতামত জানতে চান।

উপস্থিতি তাঁর কথায় সম্মতি প্রদান করলে ১৩১৭হিজরি; ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহত্তর জৈন্তা অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রাচীন ইসলামীক প্রতিষ্ঠান 'মাদ্রাসায়ে ইমদাদুল উলুম- উমরগঞ্জ'। তখনকার সময়ে জৈন্তা-অঞ্চলে সঠিকভাবে কোরআনের সঠিক শিক্ষাপদ্ধতি তথা তাজবিদের কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাঁর প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে জৈন্তা অঞ্চলে তাজবিদের মাধ্যমে কোরআন শিক্ষার প্রচলন হয়।

তশ্না উপাধিঃ ইবরাহীম তন্না মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন নিজেই শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তাঁর জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণা তখনো মেটেনি। কয়েকজন ছাত্রসহ ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। দিল্লী ছাতারি স্টেট-এ ওস্তাদ শায়খুল হাদিস মাওলানা নাজির হুছাইন মদনী (রাহঃ)-এর খেদমতে আরও দু'বছর থেকে হাদিস-শাস্ত্রে উচ্চতর সনদপ্রাপ্ত হন। ওস্তাদ জ্ঞানের তীব্র পিপাসা দেখেই তাঁকে 'তন্না' অর্থাৎ 'পিপাসু' উপাধি প্রদান করেন।

আধ্যাত্মিক জীবনঃ প্রাতিষ্ঠানিক-শিক্ষা সমাপ্তি পর তশ্না কিছুদিন হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরফ আলী থানবী (রাহঃ)-এর খেদমতে থেকে তাঁর মুরিদ হন এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে মারিফাতের কঠোর সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।

ইসলামি জলসার প্রচলনঃ তশ্না ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আসাম অঞ্চলের প্রথম ইসলামি জলসার আয়োজন করেন 'ইমদাদুল উলুম, উমরগঞ্জ' মাদ্রাসা ময়দানে। জলসার মাহফিল আয়োজন ছিল তশ্না-র এক বিরল ও ঐতিহাসিক সংস্কার আন্দোলন। জনসাধারণের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুনশি মেহেরউল্লাহ ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্যাপক ভিত্তিক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন।

সবসময়ে ইবরাহীম তশ্না সিলেট অঞ্চলে কোরআন - হাদিস আমজনতার মধ্যে প্রচারের উদ্দেশে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩২৪ হিজরি সনে ইসলামি জলসার প্রবর্তনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামি জ্ঞানের প্রচার-প্রসার হয় এবং এ আন্দোলন পরবর্তীকালে জৈন্তা অঞ্চলের সাধারণ জনতাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।

খেলাফত আন্দোলনঃ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় 'খেলাফত আন্দোলন'। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ। এ সময় খেলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী এবং শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহঃ)-এর নির্দেশে ইবরাহীম তশ্না সিলেট ও আসামের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় গ্রামেগঞ্জে অভূতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি হয়। এসময় তাঁর রচিত অনেক গান গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ছিল। ইবরাহীম তশ্নার সাহস ও রাজনৈতিক দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে অল-ইন্ডিয়া খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাঁর দিল্লি-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয়।

তশ্না যখন গ্রামেগঞ্জে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন, তখন ব্রিটিশ সরকার তাঁর ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখে এবং গ্রেফতার করে। সিলেট কেন্দীয় কারাগারে বন্দিবস্থায় তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হলে তিনি সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন-'বন্দী অবস্থায়ও আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।

এটা কখনও মনে করবেন না যে আমরা এখানে বৃথা সময় নষ্ট করছি। আমরা কখনও খ্রিস্টান সরকারের ভয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ত্যাগ করতে পারি না। রূহ জগতে আমরা করুণাময় আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি যে, আমরা দ্বীনের জন্য ও ন্যায় বিচারের জন্য সংগ্রাম করবই করব।

'ইবরাহীম তশ্না (রাহঃ) যখন সিলেট কারাগারে বন্দি তখন নামাজের সময় নামায ও আজানের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ইবরাহীম তশ্না ও ড. মর্তুজা চৌধুরী-র আন্দোলনের ফলেই তখনকার জেল কর্তৃপক্ষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় আজান ও নামাজের জন্য মসজিদের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয়।'

কারাগারে তাঁর সাথে ছিলেন মাওলানা আবদুল মুছব্বির, বিপ্লবী ও অনলবর্ষী বক্তা ফজলুল হক সেলবর্ষী, ড. মর্তুজা চৌধুরী, মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ভারত উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি জামে মসজিদে উর্দু ভাষায় তাঁর এক বক্তব্যে উপস্থিতিরা চমকে যান। তারা জানতে চায়, মাওলানা কোন এলাকার লোক। যখন জানলো তিনি বাংলার অধিবাসী, তখন 'বাংলাদেশে এমন উর্দু বক্তা আছে?'- বলে বিস্ময় প্রকাশ করে।

'কল্লোল' পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে মাওলানা আবদুল আওয়াল লিখেন, খিলাফত আন্দোলনের লক্ষ্মৌ সম্মেলনে সব নেতাই ব্রিটিশ পণ্য এবং ইংরেজি শিক্ষা বর্জনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেও দুরদর্শী তশ্না তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে-হারে ইংরেজি শিক্ষা বর্জন শুরু হয়েছে তাতে ইংরেজী শিক্ষিতরাই লাভবান হবে।

তাই তিনি লক্ষ্মৌ সম্মেলনে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা আরবি, ফারসি, উর্দু এবং অন্যান্য ভাষায় শিক্ষা অর্জন করে থাকি। তদ্রুপ ইংরেজি একটি ভাষা মাত্র। ইংরেজদের সাথে আদর্শিক ভিন্নতা থাকতে পারে, তাই বলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা অপরাধ নয়।

ইংরেজদের আচরণ অণুকরণ করাই অপরাধ।' এ বক্তব্যে তিনি দৃঢ় থাকায় সমকালীন অনেক আলেমের কাছে যদিও সমালোচিত হয়েছিলেন, তবু এতে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগ করেন তাঁর ভাতিজা পীর মাওলানা শফিকুল হক (রাহঃ)-কে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দু'শ বছরের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছিল ইবরাহীম তশ্না (রাহঃ) ছিলেন তাঁদের অগ্রসৈনিক।

কানাইঘাটের লড়াইঃ উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তেজনাকর মুহূর্তে জৈন্তিয়া-খাসিয়া পাদদেশের অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে। পাহাড়ি হিমেল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এ অঞ্চলের গণমানুষের রক্ত জেহাদি জোশে টগবগ করতে থাকে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ। ব্রিটিশ-ভারতজুড়ে দুর্বার গতিতে চলছে খেলাফত আন্দোলন। ইবরাহীম তশ্না প্রবর্তিত ইসলামি জলসা সমূহ তখন সিলেট অঞ্চলের খেলাফত আন্দোলনের চেতনা-কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ কানাইঘাট মানসুরিয়া মাদরাসার জলসা উপলক্ষে জনসভা আহবান করা হয়। ইবরাহীম তশ্নার সভাপতিত্বে জলসার কার্যক্রম শুরু হলে ব্রিটিশ প্রশাসন জলসা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সুরমা ভেলির কমিশনার জে. ই. ওয়েবস্টার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ঘটনার প্রেক্ষাপটে জনতার মাঝে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

কমিশনার গুর্খা ও পুলিশবাহিনীকে গুলি বর্ষণের আদেশ প্রদান করলে ঘটনাস্থলেই শহিদ হন স্থানীয়: মৌলভী আব্দুস সালাম (গ্রাম: বায়মপুর), মো. মুসা মিয়া (গ্রাম: দুর্লভপুর), আব্দুল মজিদ (গ্রাম: নিজ বাউরবাগ), হাজী আজিজুর রহমান (গ্রাম: সরদারিপাড়া), ইয়াসিন মিয়া (গ্রাম: চটিগ্রাম)। এ ঘটনার জের ধরে কানাইঘাটের জনগণের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় নেতৃত্বে থাকা ইবরাহীম তশ্না (রহ.) সহ অনেককে।

রচনাবলীঃ অগ্নিকুণ্ড মাওলানা ইবরাহীম তশ্না-র অমর রচনা। প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক আব্দুল জলীল বিসমিল ইবরাহীম তশ্নার উর্দু ও ফারসিতে দু'শোর অধিক এবং বাংলায় ৩৬০টি সঙ্গীতের উল্লেখ করেছেন। গ্রন্তর্ভুক্ত রচনা সমূহে উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রকাশ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর জীবনাংশের সাথে অগ্নিকুণ্ডের গুটিকয় গান প্রকাশ হয়েছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইন্সপেক্টর সেন্ট্রাল এক্সাইজ পদে চাকুরিরত উর্দুভাষী সাহিত্যিক আব্দুল জলীল বিসমিল ইবরাহীম তশ্নার জীবনীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রকাশের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেন। তবে দুঃখজনক হলো তিনি ছুটিতে পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং তিনি আর ফেরেন নি, ফলে তশ্না-র জীবনের উল্লেখযোগ্য দিক ও রচনাবলি হারিয়ে যায়।

বিসমিল 'তশ্না কি জজবা' নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিসমিল তাঁর অপর গ্রন্থ 'সিলহেট মে উর্দু' গ্রন্থে তন্নার ওপর আংশিক আলোচনা করেছেন।

একুশে বইমেলা, ঢাকা- ২০০৯-এ কবি সরওয়ার ফারুকী সম্পাদিত 'মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন' গ্রন্থে ২৯৭টি গান সংকলিত করে মদিনা পাবলিকেশন্স, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশ করলে নতুনভাবে তশ্নার ওপর দৃষ্টি পড়ে সুধীজনের।

'নুরের ঝংকার' নামে তশ্নার সঙ্গীত প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৪৪ বাংলা ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। ইবরাহীম তশ্নার জীবনী ও অগ্নিকুণ্ড গ্রন্থের কয়েকটি গান তাঁর বড়ছেলে মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে 'ইবরাহীম তশ্নার সংক্ষিপ্ত জীবনী ও অগ্নিকুণ্ড' শিরোনামে নামে ৩৪টি গানসহ একটি ছোট্ট সংকলন প্রকাশ করেন।

তশ্না-র ২য় ছেলে মাওলানা ওলিউর রহমান (রহ.) 'অগ্নিকুন্ড ও শাহ শীতালং রচিত কতিপয় রাগ' শিরোনামে ১৩৯৮ বাংলা, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে একটি বইয়ে তশ্না ও মরমি কবি শীতালং শাহ'র ওপর তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেন। এছাড়া পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, সামছুল করিম কয়েস, গবেষক আবদুল মতিন চৌধুরী সহ অনেকেই।

ইসলামি বিশ্বকোষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭০০, ২য় সংস্করণ, জুন-২০০৬খ্রিঃ-এ তন্না'র ওপর আলোচনা হয়েছে। মাওলানা ইবরাহীম তন্না উর্দু ও ফার্সি ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। অধ্যয়ন ছিল তাঁর স্বভাবজাত। স্বাভাবিকভাবে তাঁর রচনাতে উর্দু ফারসি শব্দের বিরল সমাহার ঘটে। বাংলা সাহিত্যের আধ্যাত্মিক রচয়িতাদের মধ্যে মাওলানা ইবরাহীম তশ্না ছিলেন সর্বোচ্চ একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত।

তাঁর রচনাবলি বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ এবং এতে রূপকের ব্যবহার অত্যধিক। বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল বলেছেন, 'এ কথা সত্য যে, তাঁর সঙ্গীতের মর্ম বুঝতে হলে জ্ঞান মার্গের বাসিন্দা হতে হবে।' বিশেষ করে তাঁর উর্দু ও ফার্সি রচনাসমূহ অত্যন্ত উঁচু মানের ছিল। স্বাধীনতার জন্যে ব্যাকুল তন্না দেশ ও জাতির জন্যে হৃদয়ের হাহাকার অত্যন্ত জোরালোভাবে কয়েকটি উর্দু কবিতায় বর্ণনা করেন।

কাব্যপ্রতিভা ইবরাহীম তশ্না রচনা করেছেন কয়েকখানা মৌলিক কিতাব। যে সবের মধ্যে তাজবীদ একটি। এছাড়াও লিখেছেন শরাহে কাফিয়্যা, শরাহে উসুলুসশাশী ও শরাহে তাহজীব। যদিও এ কিতাবগুলো দোষ্প্রাপ্যই বটে। সঙ্গীত বৈচিত্র সম্পাদনা ইবরাহীম তশ্না ইসলামী শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত, সুপরিচিত এক আলেম।

জীবন ধারণে তিনি ছিলেন শরিয়ত নিয়ন্ত্রিত পূর্ণাঙ্গ মুসলিম। তাঁর সঙ্গীতও চমৎকারভাবে ইসলামী ভাব নিয়ন্ত্রিত। লোক গবেষক প্রফেসর নন্দলাল শর্মা তাঁর গীতিগুচ্ছকে বিষয় বস্তু অনুযায়ী ১১টি ভাগে ভাগ করেছেনঃ আল্লাহ স্মরণ নবী স্মরণ ওলি স্মরণ মুর্শিদ স্মরণ ভক্তিমূলক ফকিরি তত্ত্ব নিগূঢ় তত্ত্ব মন:শিক্ষা দেহতত্ত্ব কামতত্ত্ব বিচ্ছেদ আল্লাহ স্মরণ বিষয়ক গীতি সংখ্যা ২৫ টি।

তশ্না বিশ্বের সর্বত্র দয়াল রব্বানি আল্লাহর জয়ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। আকাশে ও পাতালে তাঁর মহান নামের জয়ধ্বনি। আমরা ইহজগতে যাদের বন্ধু বলে জানি তারা প্রকৃত বন্ধু নয় বলে তাঁর অভিমত। মহানবী (সা.) ও স্মরণে তশ্না পঁচিশটি গান রচনা করেছেন। 'উম্মতের কান্ডারী নবী রহমতের সাগর'; তাঁর রওজা মোবারক জিয়ারত করতে সক্ষম না হওয়ায় কবি আফসোস করেছেন।

তাঁর মনে হয়েছে এজন্য তাঁর 'জমানা বিফলে গেছে'। সুফি সাধনার বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে ইবরাহীম তশ্না গান রচনা করেছেন। যেমন- ফকিরিতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব প্রভৃতি। ফকিরিতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর রচিত গীতি সংখ্যা বেশি নয়। ফকির বলতে বর্তমানে ভিক্ষুক বা উদাসী বে'শরা ফকির বা মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ানো মাদকাসক্তদের বোঝানো হয়।

এরা প্রকৃত ফকির নয়। প্রকৃত ফকির হলেন দীনের ফকির। একমাত্র আল্লাহকে লাভ করার আশায় যারা পার্থিব সুখশান্তি ভোগবিলাস বর্জন করে সৃষ্টিরহস্য অণুসন্ধানের পথে নেমেছেন।

পরিবারঃ পারিবারিক জীবনে ছিলেন ছয় সন্তানের জনক। করেছেন চার বিয়ে। প্রথম ছেলে হলেন মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান, ২য় ছেলে মাওলানা ওলিউর রহমান, ৩য়া- মেয়ে আতিকা বেগম, ৪র্থ ছেলে ক্বারী আতিকুর রহমান, ৫ম ছেলে ক্বারী জমিলুর রহমান, ৬ষ্ঠ মেয়ের নাম জানা যায়নি।

ইন্তেকালঃ এ মহান মনীষী ২সেপ্টেম্বর ১৯৩১খ্রিস্টাব্দ, ১৩৩৮ বাংলা, ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবার ৬৩ বছর বয়সে কলেরা রোগে ইন্তেকাল করেন।

তথ্যসূত্র:

সম্পাদনা উদ্ধৃতি সম্পাদনা জালালাবাদের শত মনীষা, রাগিব হোসেন চৌধুরী
দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ই ফাল্গুন, ১৪০০

বাংলা সিলহেট মে উর্দু, আবদুল জলীল বিসমিল, করাচি, পাকিস্তান
গ্রন্থপঞ্জী সম্পাদনা উদাসী

তশ্না- মাওলানা ওলিউর রহমান
স্মৃতির পাতায় জালালাবাদ- শহীদ চৌধুরী ইসলামি বিশ্বকোষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭০০, ২য়
সংস্করণ, জুন-২০০৬খ্রিঃ

সিলহেট মে উর্দু- আব্দুল জলীল বিসমিল আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের সংগ্রামী
ভূমিকা- যুলফিকার আহমদ কিশমতী

মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন, সরওয়ার ফারুকী, মদিনা
পাবলিকেশান্স।

আশরাফ সিদ্দিকী: লোক সাহিত্য হয় খণ্ড, ঢাকা ১৯৯৫

গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত: শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত

নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত: বাঁশির সুরে অঙ্গ জ্বলে, সিলেট ২০০৭

মরমী কবি শিতালং শাহ, ঢাকা ২০০৫ মুহম্মদ এনামুল হক
সূফী প্রভাব, ঢাকা ২০০৬ সৈয়দ মোস্তফা কামাল
সিলেটের মরমী সাহিত্য, লন্ডন ১৯৯৮ হরেন্দ্র চন্দ্র পাল
পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, কলিকাতা ১৩৬০

Post a Comment

Previous Post Next Post