যাকাতের বিবরণ, যাকাতের বিধি বিধান, যাকাত কাদের উপর ফরজ
যাকাতের বিবরণ:
আরবী ভাষায় “যাকাত" শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত অর্থ হইল দুইটি। প্রথমটি হইল বৃদ্ধি পাওয়া, আর দ্বিতীয়টি হইল পবিত্রতা। কুরআন শরীফে যাকাত পবিত্রতার অর্থেও ব্যবহৃত হইয়াছে। নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করিবে, যাহারা পবিত্রতা অর্জন করিবে।
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে অবশিষ্ট সম্পদের পবিত্রতা অর্জন হইবার সাথে সাথে সম্পদও বৃদ্ধি পায়। হাদীস শরীফে আছে, যাকাত আদায়ের কারণে ধন-সম্পদের কোন প্রকার ঘাটতি দেখা দেয় না, বরং ওইগুলো আরও বৃদ্ধি পায়।
ইসলামী আইনজ্ঞগণের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়, শরীয়ত কর্তৃক সম্পদের নির্ধারিত অংশকে সৈয়দ বংশীয় ব্যক্তিগণ ছাড়া যাকাত প্রাপ্য কোন অসহায় মুসলমানকে সম্পূর্ণ মালিকানা ভোগের জন্য দিয়া দেওয়া।
যাকাত আদায়ের দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পায় ও ইহাতে খুব বরকত হয়। অপরদিকে যাকাত দাতা যাকাত আদায় না করিবার পাপ এবং কৃপণতার মত ঘৃণিত ও জঘন্য অভ্যাস হইতে পবিত্র হইয়া যায়। এইভাবে যাকাতের দুটি অর্থই পরিস্ফুটিত হয়।
যাকাত হইল ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ যহা অত্যাবশ্যকীয় ও সম্পূর্ণ নিশ্চিত একটা বিধান। কোন মুসলমান ইহাকে অস্বীকার করিতে পারে না।
নামাজের গুরত্ব যেমন চিরস্থায়ী, ঠিক তদ্রূপ যাকাতের আইনও সুনিশ্চিত ও চিরস্বীকৃত বিধান। আল্লাহ্ তায়ালা প্রায় সকল স্থানেই নামাযের সাথে সাথে যাকাতের নির্দেশ দিয়াছেন।
যাদের ওপর যাকাত দেয়া ফরয
যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণের জন্য, যাহাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাহাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তগণের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরগণের জন্য। ইহা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (সূরা তওবা-৬০)। এই আয়াতের মধ্যে আল্লাহ্ তাআলা যাকাত প্রাপ্য ব্যক্তিগণকে আট শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। এই আট প্রকার লোকগণের ছাড়া অন্য কাহাকে যাকাত প্রদান করা যাইবে না।
ইহাদের ভিতর একই সাথে সবাইকে বা যেই কোন শ্রেণীর একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান করা যায়। আয়াতে উল্লিখিত আট শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের আলোচনা এইখানে সংক্ষেপে তুলিয়া ধরিতেছি।
এক: স্বল্প সামর্থবান দরিদ্রগণ। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইবে ঐসব লোক যাহাদের নিকট যাকাত ফরজ হইবার ন্যূনতম পরিমাণ অর্থাৎ "নিসাব" এর চেয়ে কম সম্পদ রহিয়াছে। এই স্বল্প পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিগণের জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েজ আছে।
তবে এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যক্তির জন্য কাহারো নিকট হাত পাতা তথা ভিক্ষা বৃত্তি করা জায়েজ নাই। ঠিক তদ্রুপ কোন ব্যক্তির "নিসাব" পরিমাণ সম্পদ রহিয়াছে।
কিন্তু এই সম্পদের উৎপাদন শক্তি নাই এবং এই ব্যক্তিও বিভিন্ন আর্থিক অভাবে জর্জরিত, এম তাবস্থায় এই ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ করা শরীয়ত সম্মত হইবে।
দুই: সহায় সম্বলহীন দারিদ্রগণ। এইখানে ঐসব লোকদিগকে বুঝানো হইয়াছে যাহাদের কোন সম্পদ নাই। ইহাদের মধ্যে যাহারা শারীরিক দিক দিয়া উপার্জন করিতে অক্ষম এবং তাহাদের নিকট মাত্র একদিনের অন্নের ব্যবস্থাও নাই। এই পরিস্থিতিতে ইহারা শুধু ওই দিনটির আহারের জন্য লোকের কাছে হাতও পাতিতে পারে।
তিন: যাকাত কর্মচারী। যাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত প্রায় সকল কর্মচারী এই শ্রেণীর আওতাভুক্ত হইবে। যেমন: আদায়কারী, হিসাবরক্ষক, ওজনকারী, বিতরণকারী ও যাকাত সংক্রান্ত সার্বিক কাজের তদারককারীগণ।
এইসব কর্মচারীগণকে কাজ-কর্মের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখিয়া তাহাদের এবং তাহাদের পরিবারস্থ লোকগণের মোটামুটি চলিবার ব্যবস্থা হয় এই পরিমাণ অর্থ যাকাত ফান্ড হইতে দেওয়া যাইতে পারে।
চার: কোন মুসলমানকে তাহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যাকাত কর্মচারীদিগকে সহযোগিতা করিবার জন্য যাকাত ফান্ড হইতে অর্থ প্রদান করা।
পাঁচ: শরীয়ত সম্মত ক্রীতদাস। এই শ্রেণীতে শুদু মুক্তির আদেশপ্রাপ্ত ক্রীতদাস অন্তর্ভুক্ত হইবে। তাহাছাড়া যাকাতের দ্বারা সাধারণ দাস-দাসীকে ক্রয় করিয়া মুক্ত করিলে যাকাত আদায় হইবে না। কেননা, যাকাতের অর্থ যাকাতগ্রহীতার মালিকানায় দিয়া দিতে হয়।
কিন্তু এইখানে হচ্ছে না। সাধারণ দাস মুক্তির জন্য যাকাত ব্যতীত অর্থ ব্যবহার করিয়া এই মঙ্গলজনক কাজে শরীক হইতে হইবে।
ছয়: ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিবর্গ। যাহাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ রহিয়াছে ঠিক, কিন্তু এই নিসাবের সাথে সাথে তাহাদের ঘাড়ে ঋণও চাপিয়া আছে এবং এই ঋণ পরিশোধ করিলে সম্পদ আর নিসাব পরিমাণ থাকে না। তখন উহাদিগকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাইবে।
তবে তাহাদের অধিকৃত সম্পদ হইতে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। এই সম্পদ ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট না হইলে যাকাতের অর্থ দ্বারা ঋণ পরিশোধ করা যাইবে।
সাত: আল্লাহর পথে। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইবে ঐসব লোক যাহারা যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক বা পূর্বে হজ্জ্ব ফরয হইয়াছে এই হজ্জ্ব করিতে ইচ্ছুক অথচ তাহারা দরিদ্র। উহাদিগকে যুদ্ধ বা হজ্জ্বব্রত পালন করিবার সহায়তার জন্য যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।
যেইসব গরীব লোক ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য লেখাপড়া করিতেছে বা শিক্ষকতা করিতেছে তাহাদিগকে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিয়া যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাইতে পারে।
আট: পথচারী মুসাফির। ভ্রমণ অবস্থায় কেহ অর্থের মুখাপেক্ষী হইলে প্রয়োজন মোতাবেক অর্থ যাকাত তহবিল হইতে গ্রহণ করিতে পারে, যদিও তাহার বাসস্থানে অনেক সম্পদ রহিয়াছে।
এমনিভাবে যাহারা ভ্রমণ করা ছাড়াই নিজ সম্পদ হইতে অনেক দূরে রহিয়াছে এবং ওই সম্পদ ভোগ করিতে অক্ষম, তাহারাও পথচারীগণের অন্তর্ভুক্ত হইবে। তবে এইসব পথচারীগণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার না করিয়া কাহারো নিকট হইতে ঋণ হিসাবে অর্থ গ্রহণ করাটাই সর্বোত্তম।
যাকাতের পরিমাণ
এইভাবে ৩৯৯ বকরীর পর অতিরিক্ত প্রতি ১০০ টির জন্য ১টি করিয়া খাসী বা বকরী যাকাত বাবদ প্রদান করিতে হইবে। একক মালিকের অধিকৃত নিসাবের দুই স্তরের মাঝে যেই সব ছাগল রহিয়াছে ঐগুলোর উপর যাকাত ধার্য হইবে না।
যেমন : কোন এক ব্যক্তির ১২০টি ছাগল থাকিলে যাকাত বাবদ ১টি বকরী দিতে হইবে কিন্তু এই ১২০টি বকরী দুই ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে উভয়ের ১টি করিয়া মোট দুইটি বকরী দিতে হইবে। তদ্রূপ এই সমসংখ্যক বকরী ৩ জনের মালিকানায় থাকিলে প্রত্যেকের উপর ১টি করিয়া মোট ৩টি বকরী আদায় করিতে হইবে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তিই ন্যূনতম নিসাব অর্থাৎ ৪০টি বকরীর মালিক রহিয়াছে। সুতরাং তাহাদের প্রত্যেকের ১টি করিয়া যাকাতও প্রদান করিতে হইবে।
স্বর্ণ-রৌপ্য ও টাকার যাকাতের বিবরণ
যাকাত ফরজ হইতে হইলে সম্পদের উৎপাদন ক্ষমতা অবশ্যই থাকিতে হইবে। এই উৎপাদক ক্ষমতাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক-প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পদ যেমন: সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা ও কৃষিজ উৎপাদন। এইগুলোর মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালা স্বভাবগতভাবেই এই ক্ষমতা গচ্ছিত রাখিয়াছেন।
দুই-সম্ভাব্য উৎপাদক ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পদ। যেমনঃ ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত জিনিসপত্র। অর্থাৎ যেই সব জিনিসপত্র ব্যবসার জন্য প্রস্তুত করিয়া রাখা হইয়াছে বা ব্যবসায়ের নিয়তে ক্রয় করা হইয়াছে।
গৃহপালিত পশু যেইগুলো পুরা বছর বা বছরের অধিকাংশ সময় নিজে নিজে মাঠে চারণ করিয়া জীবিকা আহরণের মাধ্যমে জীবন ধারণ করে, মালিককে একেবারে সামান্য ব্যয়ভার হয়ত বহন করিতে হয়। ঐসব গৃহপাতিল পশুকেও প্রথম প্রকার সম্পদের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।
কারণ, ঐগুলো বাচ্চা প্রসবের মাধ্যমে বংশবিস্তার লাভ করিয়া প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পদে রূপান্তরিত হইয়া থাকে।
যাকাত না দেয়ার ভয়াবহতা
আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যাহা তোমাদিগকে দিয়াছেন তাহাতে যাহারা কৃপণতা করে (সম্পদের যাকাত প্রদান না করে) তাহাদের ইহা মঙ্গল, ইহা যেন তাহারা কিছুতেই মনে না করে। না, ইহা তাহাদের জন্য অমঙ্গল। যাহাতে কৃপণতা করিবে কিয়ামতের দিন ইহাই তাহাদের গলার বেড়ি হইবে।
আসমান ও জমীনের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যাহা কর আল্লাহ্ তাহা বিশেষভাবে অবহিত (আল-ইমরান-১৮০)। আল্লাহ্ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুরীভূত করে এবং ঐগুলি আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাহাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।
যেইদিন জাহান্নামের অগ্নিতে ঐগুলি উত্তপ্ত করা হইবে এবং ঐগুলি দ্বারা তাহাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হইবে সেইদিন বলা হইবে, ইহা উহা যাহা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করিতে। (তওবা-৩৪৫)। নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেন, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, নবীজী (সাঃ) বলেন, যাহাকে আল্লাহ্ পাক ধনৈশ্বর্য দান করিয়াছেন এবং সে এই ধন-সম্পদের যাকাত প্রদান করেন না, কিয়ামতের দিন এই সম্পদ বিষধর স্বর্পে পরিণত হইবে। এই সর্পের চোখে দুইটি সাদাবিন্দু থাকিবে।
স্বর্পটি তাহার গলায় ঝুলিতে থাকিবে এবং তাহার উভয় অধর প্রান্তে দংশন করিতে থাকিবে ও বলিবে-আমিই তোমার সঞ্চিত ধন। অতঃপর নবী করিম (সাঃ) সুরায়ে আল-ইমরানের একটি আয়াত তেলওয়াত করেন। (আয়াত ও তাহার অর্থ উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে)।
নবী করিম (সাঃ) আরও বলেন, হযরত আবু যর (রাঃ) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করিম (সাঃ) এর দরবারে হাজির হইলাম। তিনি পবিত্র কা'বা শরীফের ছায়ায় উপবিষ্ট ছিলেন। আমাকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, কা'বার প্রতিপালকের শপথ, "তাহারাই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত"।
তৎক্ষণাৎ আমি দাঁড়াইয়া আরজ করিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) আপনার উপর আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক-ওই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ কাহারা? উত্তরে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করিলেন, তাহারা হইল অধিক ধনৈশ্বর্যের মালিক।
হ্যাঁ, তবে যাহারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এইদিক সেইদিক ডানে-বামে মোট কথা আল্লাহ্র নির্দেশিত সকল পথেই ব্যয় করিয়াছে তাহারা ক্ষতিগ্রস্তগণের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু ইহাদের সংখ্যা খুবই নগন্য। হে আবু যর!
তুমি জানিয়া রাখ, উট, গরু, ছাগল-বকরীর মালিক যাহারাই যাকাত দিবে না, কিয়ামতের দিন ঐসব জীবজন্তু অত্যন্ত সবল ও মোটাতাজা হইয়া একের পর এক তাহাদেরকে পদতলে পিষ্ট করিতে থাকিবে।
সর্বশেষ পশুটির পদতলে পিষ্ট করা শেষ হওয়া মাত্র আবার প্রথম হইতে পশুগুলো এইরূপ করিতে থাকিবে যতক্ষণ না জান্নাত-জাহান্নামের সুনির্দিষ্ট ফয়সালা হয়। (মুসলিম ও নাসায়ী)।
কুরআন ও হাদীসে যাকাত আদায় না করিবার এই ধরনের কঠোর হইতে কঠোরতম আরও বহু শাস্তির কথা বলা হইয়াছে। জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতা সম্বন্ধে যাহাদের ঈমান রহিয়াছে তাহাদের জন্য সামান্য একটি শাস্তির প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট।

0 Comments